আমরা বারে বারে একই গাড্ডায় পড়তে থাকি, বুঝলেন? মানে আমরা বিশ্বজগত, আমাদের নিজেদের শরীর, আর নানা প্রযুক্তি যত জানতে-শিখতে থাকি – ততই নানা রকম সাম্রাজ্য গড়তে থাকি আমরা, আর তারপর ভাঙ্গতে থাকি তাদের একে একে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তাই লেখা। বা নির্বোধের মত আমরা নানা রকম যুক্তি দেখিয়ে আর আবেগ চাড়িয়ে যুদ্ধ বাধাতে থাকি। তাতে ফল হয় এই যে, নিহত, আহত, দারিদ্র, খিদে আর রোগে চারদিক ছেয়ে যায়, আর পরের বারের যুদ্ধপরিস্থিতির পথ সুগম হয়। আমরা ইতিহাসের দিকে ফিরে ফিরে এই সমস্ত কিছু দেখতে পাই, তবু তুড়ি মেরে সব উড়িয়ে দিয়ে ব’লি, এই তো জগতের নিয়ম। জগত এমনই ছিল, এমনই চলছে, চলবে।
– অক্টাভিয়া বাটলার, প্যারাবেল অফ দ্য ট্যালেন্টস
ইন্টারনেট বিশ্বব্যাপী বৈষম্য আর বিভাজনকে আরও গভীর করছে কিভাবে?
ইন্টারনেটের সভায় কাদের জ্ঞানের ঠাঁই আছে আর কাদের নেই?
এইসব জ্ঞান কারা, কিভাবে উৎপাদন করছে?
ইন্টারনেট, তুমি কাদের? কাদের ইন্টারনেট-স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, কাদের পক্ষে আমরা লড়ছি?
জ্ঞান
সারা বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারের একটা খুবই ছোট অংশ ধরা আছে বইতে, ছবিতে বা মৌখিক রূপে। আর ইন্টারনেটকে যতই মুক্ত আর গণতান্ত্রিক মনে হোক না কেন, আমাদের নিত্যব্যবহার্য জ্ঞানের জমির ঢালকে তা আরও একমুখী করে দেয়।
গুগলের হিসাবে ইং ২০১০ সালে সারা পৃথিবীতে ১.৩ কোটি বই আছে, ৪৮০টি ভাষায়। তার মধ্যে মাত্র ২০% গণপরিসরে বিনামূল্যে লভ্য আর মাত্র ১০-১৫%-এর ছাপাই চালু আছে। পৃথিবীর ৭০ কোটি মানুষ প্রায় ৭০০০ ভাষা আর বাচনে কথা বললেও, তার মাত্র ৭% ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের সেই ছাপা জ্ঞানভান্ডারের এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ডিজিটাল জ্ঞানে পরিণতি পেয়েছে। আর সেই ডিজিটাল জ্ঞানের এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ রয়েছে ইন্টারনেটে।
বিভিন্ন প্রান্তিক সম্প্রদায়ের জ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতাকে ইন্টারনেট জ্ঞানতন্ত্রের ভরকেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য, যা যা রসদ আর পদ্ধতি লাগে তার পরিচালনা আমরা করে চলেছি। উইকিপিডিয়ার অনলাইন জ্ঞানভান্ডার এর এক শুরুয়াতমাত্র। উইকিপিডিয়া অনলাইন জগতের অন্যতম জনপ্রিয় একটি জ্ঞানচর্চার ওয়েবসাইট, অতএব তাকে সমগ্র অনলাইন জ্ঞানভাণ্ডারের বকলম হিসাবে ধরা যেতেই পারে। কিন্তু উইকিপিডিয়া যে বিশ্বজ্ঞানভাণ্ডারের প্রতিনিধি নয়, তা আমরা জানি।
যদি আমরা উইকিপিডিয়াকে অনলাইন মুক্ত জ্ঞানভান্ডারের সূচক বা প্রতিনিধি হিসাবে দেখিও, তাহলে মনে রাখতে হবে যে পৃথিবীর ২০% (মুখ্যত উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ পুরুষ সম্পাদকরা) উইকিপিডিয়ার ৮০% সম্পাদনা করে্ন আর হিসেবমতে প্রতি দশজন উইকিপিডিয়া সম্পাদকের মধ্যে একজনমাত্র নারী হিসাবে স্বপরিচয় দেন। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইন্সটিটিউটের মার্ক গ্রাহাম ও তাঁর সহকর্মীদের গবেষণামতে উইকিপিডিয়া প্রবন্ধমালার ৮৪% ইউরোপ ও আমেরিকা সংক্রান্ত। আর ভূগোলকীয় দক্ষিণ নিয়ে বেশীর ভাগ প্রবন্ধ লেখা হয় ভূগোলকীয় উত্তরে বসে, অতএব কন্টেন্ট থাকলেও, তার দশা বেশ একপেশে।
উইকিপিডিয়ার জ্ঞানভান্ডারের নানা গুরুত্বপূর্ণ ফাঁক শনাক্ত করতে ও নতুন, উন্নততর কন্টেন্ট দিয়ে সেই ফাঁক ভরাট করতে বিভিন্ন সম্প্রদায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। যেমন ভারতের দলিতরা, বসনিয়া আর হারজেগোভিনার কুঈয়ার নারীবাদীরা আর কুমেয়ায় গোত্রের দেশজ আমেরিকানরা নিজেদের নিজেদের জ্ঞানভান্ডার দিয়ে নানা শূন্যস্থান পূরণ করে চলেছেন। এই সব প্রচেষ্টার জন্য আমাদের সমর্থন ও উদ্যম পুরোমাত্রায় আছে। আমরা ক্রমাগত নতুন নতুন সুযোগ খুঁজতে থাকি যাতে আরও আরও সম্প্রদায়ের সাথে আমরা নিজেদের কর্মকান্ডকে জুড়তে পারি ও তাঁদের জন্য অনলাইন জমি গড়ে তুলতে পারি।
যে সব প্রশ্ন আমাদের খুব কাছের:
- জ্ঞান উৎপাদনে ভাগ নেওয়ার জন্য কাদের কাদের ডাক পড়ে?
- আমাদের জ্ঞানের উৎসকে কিভাবে আরও বিভিন্নতা দেওয়া যায়?
- ‘নিরপেক্ষতা’ কতদূর ভালো?
নজরদারি, গোপনীয়তা আর সুরক্ষা
নানা ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের ওপর এক অভূতপুর্ব নজরদারির যুগ নিয়ে এসেছে। লাগামছাড়া ডাটা সঞ্চয় আর ব্যক্তিগত গোপনীয়তারক্ষার মধ্যে যে সহজাত বিরোধ আছে, তা নানা দেশের সরকারকে নানা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে, ‘বিস্মৃত হওয়ার অধিকার’ আইনের চোখে মান্যতা পেয়েছে, আর বিভিন্ন সংস্থা ব্যক্তিগত ডাটা কি কি ভাবে ব্যবহার করতে পারে তাতে লাগাম লাগিয়েছে এক নতুন ডাটা সুরক্ষা আইন। সাম্প্রতিককালে এডওয়ার্ড স্নোডেন ও অন্যদের করা নানা পর্দাফাঁস এটাই প্রমাণ করেছে যে বিভিন্ন দেশের সরকার (ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশেরও) কিভাবে তাদের নাগরিকদের ওপর নজরদারি চালায় আর মানবাধিকাররক্ষীদের কোনও ন্যায্য কারণ ছাড়াই নজরবন্দী রাখে।
অসাম্য ডিজিটাল যুগের নজরদারি ও গোপনীয়তার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা যখন বিশেষাধিকার হয়ে দাঁড়ায়, ভূগোলকীয় উত্তরে যা সুরক্ষিত, তখন ধরেই নেওয়া যায় ভূগোলকীয় দক্ষিণে ডাটা নিষ্কাশনের হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
ডিজিটাল নজরদারির রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক মাত্রা আছে। মানবাধিকাররক্ষী আর রাজনৈতিক আন্দোলনকারীদের বেছে বেছে প্রায়শঃই নজরবন্দী করা হয়। ট্যাক্টিক্যাল টেকনোলজি কালেক্টিভের গবেষণায় প্রকাশ, রাষ্ট্র মানবাধিকাররক্ষীদের অনলাইন সুরক্ষা ও গোপনীয়তার সাথে আপস করে তাঁদের জীবনে দৈনিক হেনস্থা আর গভীরভাবে অনুচিত নানারকম হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে বিকল্প কোনও রাজনৈতিক দর্শন বা প্রকল্পগঠনের (যেমন ইন্টারনেটের গণতন্ত্র বৃদ্ধি) পথ রুখে যায়, আশা নিভে যায়।
তার ওপর, যাঁরা নারী, যাঁরা বিভিন্নলিঙ্গপরিচয়ধারনকারী, যাঁদের চামড়া সাদা নয়, তাঁদের ইন্টারনেটে হেনস্থা হওয়ার ও গালিগালাজ খাওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি। ‘দি ইউনাইটেড নেশান্স রিপোর্ট অন সাইবার ভায়োলেন্স এগেন্স্ট উওমেন অ্যান্ড গার্লস’-এর মতে ৭৩% নারী কোন না কোন ভাবে অনলাইন হিংসার সম্মুখীন বা শিকার। এই প্রান্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা অফলাইন জগতে বৈষম্যের শিকার তো বটেই, কিন্তু অনলাইন জগতে নিজেদের মতামত মুক্তভাবে প্রকাশ করতে গিয়েও এঁরা যথেষ্ট বৈরিতার মুখোমুখি হ’ন। আমাদের এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গোপনীয়তা-প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জানা উচিত যাতে আমরা এমন এক ইন্টারনেট গড়ে তুলতে পারি যেখানে সবাই স্বচ্ছন্দ ও স্বাগত। যে ইন্টারনেটে গোপনীয়তা মানে শুধু ব্যক্তিমানস প্রকাশে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি নয়। অনলাইনে যাঁরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার অধিকার বজায় রাখাও সেই গোপনীয়তার অঙ্গ। বিভিন্ন ইন্টারনেট কর্পোরেশনের গোপনীয়তা সংক্রান্ত নীতিমালা বেশীর ভাগ সময় অনলাইন বৈচিত্রবৃদ্ধি আর অংশগ্রহণের পথ সুগম করার বদলে আরও দুর্গম করে তোলে। যেমন ফেসবুকের ‘রিয়্যাল নেমস’ নীতি, যা এলজিবিটিকিউআই এবং দেশজ আমেরিকান সম্প্রদায়ের বেশ ক্ষতি করেছিলো।
যে সব প্রশ্ন আমাদের খুব কাছের:
- ভূগোল, শ্রেণী, জাতি ও লিঙ্গবিশেষে গোপনীয়তা আর বিশেষাধিকার কি কি ভাবে যুক্ত?
- গোপনীয়তার অধিকার কার গোপনীয়তা রক্ষা করে?
- কার সুরক্ষার দাম বেশি?
- গোপনীয়তা যে শুধু অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি নয়, তার চেয়েও বেশী এক সুরক্ষার অঙ্গীকার – তা আমরা কিভাবে বুঝব আর বোঝাবো?
- ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আর ডাটা-নীতিকারের মধ্যে জ্ঞানের যে ব্যবধান তার ওপর কি করে সেতু বাঁধবো আমরা?
- যে সব প্রযুক্তি প্রকল্প আমাদের গোপনীয়তারক্ষাকাজে নিয়োজিত সেগুলির আর যেসব ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা ঝুঁকির মধ্যে, তাঁদের মধ্যে সংহতি সংঘ কি ভাবে গড়ে তুলবো আমরা?
ডিজিটাল অবকাঠামো
বাড়ী তৈরি হয় ইট, ইস্পাত, তার আর ফিউজ দিয়ে। ইন্টারনেটেরও কাঠামো আছে। স্থূল ও সূক্ষ্ম অবকাঠামো দিয়ে তা গড়া – সার্ভার, ফাইবার অপটিক কেবল, কোড আর অন্যান্য জিনিসে। ইন্টারনেটের অন্তর্লীন কাঠামো অনেকভাবেই ঠিক করে দেয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা কিভাবে একে রসদ বা স্থান হিসাবে ব্যবহার করবে। কিন্তু জরুরী কথা এই যে, এই সব কাঠামো বেশির ভাগ সময়েই অদৃশ্য। আমরা সবসময় জানি না কোনো ওয়েবসাইটের আধার যে সার্ভার, তার ঠিকানা কি, আর পর্দার পেছনে চলমান কোন কোড ঠিক করে দিচ্ছে আমাদের সার্চ ইঞ্জিনের ফলাফল, তা তো আমরা একেবারেই জানি না। আমাদের গড়ে তোলা বাড়ীর মত আমাদের ইন্টারনেটও বিভিন্ন মানুষিক সিদ্ধান্তের ফলাফল। তা কিরকম হওয়া উচিত, তা কিছু মানুষের সিদ্ধান্ত থেকেই নির্নিত হচ্ছে। অতএব সেই সিদ্ধান্ত কোন মানুষরা নিচ্ছে, তা জানা আমাদের জন্য জরুরী বৈকি!
যেহেতু ইন্টারনেটের অবকাঠামো আমাদের কাছে অদৃশ্য, অতএব তাতে যেসব বৈষম্য বোনা আছে সেসবও অদৃশ্য। কিন্তু বৈষম্য বিলক্ষণ আছে। বেশীর ভাগ সার্ভার (যা ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট আর ব্যবহারকারীদের ডাটার আধার) ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা বা ইউরোপে অবস্থিত, যদিও সারা বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের তিন-চতুর্থাংশ ভূগোলকীয় দক্ষিণে অবস্থিত। পৃথিবীর কিছু কিছু অঞ্চল বা দেশ বেশী ‘যোগাযোগসম্পন্ন’ অন্যদের তুলনায়, কারণ দীর্ঘ, জটিল ঐতিহাসিক কারণে কোথাও সুবিধা বেশি পাইয়া গেছে, কোথাও কম – যোগাযোগ সমৃদ্ধির ভূগোলও সেভাবে বদলে গেছে। অধিকাংশ কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট আর ইঞ্জিনিয়ার (এখনো) পুরুষ, আর ইন্টারনেটের সবচেয়ে বুনিয়াদি প্রয়োগের জন্য লেখা এলগরিদমের মধ্যে জাতিবাদী আর পুরুষবাদী লক্ষণ সুস্পষ্ট। আমরা যেহেতু ক্রমশঃ সচেতন এলগরিদম (‘আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স’) গড়া শুরু করে দিয়েছি – সেই এলগরিদমে চেতনাসঞ্চারের পাঠ কিভাবে ও কাদের দ্বারা পড়ানো হচ্ছে, তা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে।
যে সব প্রশ্ন আমাদের খুব কাছের:
- ইন্টারনেটের ভূগোল দেখতে কেমন?
- আমরা যে ইন্টারনেট রোজ দেখি আর ব্যবহার করি, তা গড়ছে কে?
- ইন্টারনেটের অদৃশ্য অবকাঠামোর মধ্যে কি কি বৈষম্য বোনা আছে?
- কোড কখনই নিরপেক্ষ হতে পারে না (কারণ কোড মানুষে লেখে!), কিন্তু তাকে আমরা মানবিকতাপূর্ণ কিভাবে করতে পারি?
- কিভাবে আমরা এক আরও বিকেন্দ্রীভূত আর আরও স্বায়ত্তশাসিত ইন্টারনেট অবকাঠামো তৈরি করতে পারি?
Translation: Sourav Roy